Volume 1 Issue 1                                                                                                           

Gandharvam, A Refereed Journal of Sachin Debbarman Memorial Govt. Music College

 

বিবর্তনের ধারায় বিষ্ণুপুর ঘরানার রাগরাগিনী ও সেতার বাদন চর্চা

By সিদ্ধার্থচৌধুরী

 

মুসলিম দরবারী সংগীতের ক্ষেত্রে উত্তর ভারতে ‘ঘরানা’ পরিভাষাটির বহুল প্রচলন দেখা যায় I কিন্তু মধ্যযুগীয় হিন্দু সংগীতশাস্ত্রের কোন গ্রন্থে ‘ঘরানা’ পরিভাষাটির ব্যবহার নেই I অষ্টাদশ শতাব্দী থেকেই নাগরিক বিভিন্ন সংগীতে এবং দরবারী সংগীতের ক্ষেত্রে রীতি, স্টাইল, চাল প্রভৃতি শব্দের পরিবর্তে ঘরানা শব্দটি ব্যবহার হতে দেখা যায় I

পূর্বে প্রথমত উনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন বাংলার সাহিত্যকর্মে বিষ্ণুপুর ঘরানার ধ্রুপদ এই শব্দের পরিবর্তে বিষ্ণুপুরী চালের ধ্রুপদ শব্দটি ব্যবহৃত হতে থাকে l রাঢ়-অঞ্চলের বিষ্ণুপুর নগরী সংগীত সাধনার অন্যতম পীঠস্থান রূপে পরিচিত l কবিগান, পাঁচালি, যাত্রা ইত্যাদি লোকগীত এবং অভিজাত নাগরিকগীত চর্যাগীতি, গীতগোবিন্দ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন প্রভৃতির সঙ্গে সমান্তরালভাবে বিষ্ণুপুরে উচ্চাঙ্গের দরবারী সংগীত চর্চার সূত্রপাত l

সংগীত গবেষক দিলীপকুমার মুখোপাদ্ধ্যায়ের মতে – “বিষ্ণুপুর ধ্রুপদ, খেয়াল, টপ্পা ইত্যাদি অঙ্গের কন্ঠসংগীত এবং সেই সঙ্গে সেতার, সুরবাহার, পাখোয়াজ, বীণা চর্চার জন্য এই সংগীতপীঠ কীর্তিত আছে l”  

বিষ্ণুপুর ঘরানার কিছু রাগ-রাগিনী পরিচয় প্রসঙ্গে বলা যায়-পূর্বের এই ঘরানার শিল্পীদের থেকে পুরুষানুক্রমে বিবর্তনের ধারায় বর্তমান প্রজন্মের এই ঘরানার শিল্পীদের রাগ-রাগিনীর পরিবেশনগত পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় l বর্তমান আলোচনা প্রসঙ্গে আসাবরী, রামকেলী এই রাগ দুটি নির্বাচন করা হল l এই রাগ-রাগিনী গুলি ছাড়াও আরও অনেক রাগ-রাগিনী আছে যা পুরুষানুক্রমে বিবর্তনের সাথে সাথে পার্থক্য লক্ষণীয়-যা উৎসাহি পাঠক ও গবেষক প্রয়োজনে অনুসন্ধান করে দেখতে পারেন I

বর্তমানে আসাবরী রাগিনীর দুটি রূপ দেখতে পাওয়া যায়-একটিতে শুদ্ধ ঋষভ ও অপরটিতে কোমল ঋষভ যুক্ত I বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতগুণী গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায় মহাশয় তাঁর ‘সঙ্গীতচন্দ্রিকা’ নামক গ্রন্থে যতগুলি আসাবরী রাগিনীর গান সংকলিত করেছেন তার সবকটি-ই কোমল ঋষভ যুক্ত I কিন্তু তিনি এই রাগের যে পরিচয় দিয়েছেন, তার সঙ্গে এই ঘরানার অপর সংগীতগুণী রামপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের রচিত ‘সঙ্গীতমঞ্জরী’ নামক গ্রন্থে প্রদত্ত আসাবরী রাগিনীর পরিচয়ে পার্থক্য দেখা যায় I সঙ্গীতচন্দ্রিকায় এই রাগিনীর বাদী-সমবাদী স্বর যথাক্রমে কোমল ধা(দা) ও কোমল গা (জ্ঞা)I এই রাগিনীর অবরোহন-র্সা ণা দা পা মা পা জ্ঞা মা ঋা সা I  সঙ্গীতমঞ্জরী গ্রন্থে এই রাগিনীর বাদী-সমবাদী স্বর যথাক্রমে পা ও সা এবং এই রাগিনীর অবরোহন-র্সা ণা দা পা মা জ্ঞা ঋা সা  I       

দুজন সংগীতগুণী বাদী-বাদী-সমবাদী স্বরের পার্থক্য ছাড়াও অবরোহনে পার্থক্য দেখা যায় I প্রথমজন অবরোহনে মা ও জ্ঞা স্বর দুটি বক্রভাবে ব্যবহার করেছেন I কিন্তু সঙ্গীতমঞ্জরী গ্রন্থে প্রদত্ত অবরোহনটি খুবই সরল প্রকৃতির I আমরা এর থেকে একটি সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে সঙ্গীতমঞ্জরীর গ্রন্থকার সঙ্গীতচন্দ্রিকার গ্রন্থকারের পূর্বসুরী এবং প্রথমদিকে বাংলার এই রাগিনীর পরিচয় অনেকটা সরল প্রকৃতির হলেও পরবর্তীকালে ভৈরবী রাগিনীর প্রভাবকে হ্রাস করার জন্য এই রাগের চলনকে কিছুটা বক্র করতে হয়েছিল I

রামকেলী রাগের ক্ষেত্রে সঙ্গীতমঞ্জরী গ্রন্থে এই রাগের বাদী স্বর পা এবং এই রাগে কড়ি মধ্যম ব্যবহার ঠিক নয় বলে উল্লেখিত হয়েছে I  কিন্তু সঙ্গীতচন্দ্রিকায় এই রাগের পরিচয়ে বলা হয়েছে, এই রাগের বাদী স্বর মা এবং তীব্র ও শুদ্ধ উভয় মধ্যম ব্যবহৃত হয় ও সঙ্গীতমঞ্জরী গ্রন্থের চলন থেকে এর চলনে পার্থক্য দেখা যায় I             

এতক্ষন বিষ্ণুপুর ঘরানায় পূর্বের সংগীত গুনীদের থেকে পুরুষানুক্রমে বিবর্তনের সাথে সাথে বর্তমান প্রজন্মের এই ঘরানার শিল্পীদের রাগ-রাগিনীর পরিবেশনগত যে পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায় সে সম্পর্কে আলোচনা করলাম I এবার বিষ্ণুপুর ঘরানায় সেতার বাদন চর্চার ক্ষেত্রেও গুরুশিষ্য পরম্পরায় বাদন শৈলীগত যে ক্রম-বিবর্তন ও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, সে সম্পর্কে আলোচনা করব I

সংগীতের ক্ষেত্রে একটি কথা প্রচলিত আছে যে , বীণ বা বীণা যেমন ধ্রুপদীয়াদের সহযোগি বাদ্যযন্ত্র , তেমনি খয়াল গায়ক বা কওয়াল্-বচ্চে ঘরানার গায়করা সহযোগি বাদ্যযন্ত্র হিসেবে সারেঙ্গী ও সেতার যন্ত্র ব্যবহার করতেন l সুতরাং আমরা এমন সিদ্ধান্তে আসতে পারি বিষ্ণুপুরে খয়াল চর্চার পূর্বে পদ্ধতিগতভাবে সেতার বাদনের ধারা প্রচলিত থাকা সম্ভব নয় l

প্রামান্য তথ্যের ভিত্তিতে রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-কে বিষ্ণুপুর ধ্রুপদ ঘরানার আদিগুরু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে যাবতীয় গ্রন্থে I তার আগের ইতিহাস প্রক্ষিপ্ত এবং কোন সঙ্গীতজ্ঞ-ই যথাযথ প্রমান দেখাতে পারেননি এই ঘরানার সৃষ্টির প্রসঙ্গে I

রামশঙ্কর ভট্টাচার্য পশ্চিম থেকে আগত এক হিন্দুস্থানী ধ্রুপদ গায়কের(?) কাছে ধ্রুপদ শিক্ষা করেন , পরে একজন খয়াল গায়কের (?) কাছে খয়াল ও টপ্পা গান শিক্ষা করেন l তার জ্যেষ্ঠ পুত্র মাধব বীণা-বাদক ছিলেন l তার পুর্ববর্তী অন্য কোন বাঙালী বীণকারের কথা এখনও জানা যায়নি l বাংলায় সেতার বাদন চর্চার প্রচলন হয় বীণা-বাদন প্রবর্তনের পরে l

বিষ্ণুপুর ঘরানার একজন বিশিস্ট সঙ্গীতজ্ঞ হলেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী (১৮২৩-১৮৯৩ খ্রি:)l তিনি রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের নিকট ধ্রুপদ শিক্ষা লাভ করেছিলেন l পরবর্তীকালে কাশীর বিখ্যাত বীণা-বাদক লক্ষ্মীপ্রসাদ মিশ্রের কাছে ধ্রুপদ গানের সঙ্গে সঙ্গে সেতার ও সুরবাহার শিক্ষা করেন l তিনিতিন রেখার দন্ড-মাত্রিক স্বরলিপি আবিস্কার করেন l  তিনি তার সংগীতসার (১৮৭৯ খ্রি:) নামক গ্রন্থে লিখেছেন-“সেতার যন্ত্রে সচরাচর পাঁচটি তার আবদ্ধ করা প্রচলিত , তন্মধ্যে দুইটি পাকা লৌহ এবং তিনটি পীত্তল দ্বারা নির্মিত , পীত্তলের তার গুলিকে কাঁচা তার কহে l”  

সে সময় সেতারের পর্দ্দা(Fret)পীত্তলের sheet দ্বারা নির্মিত হত এবং তার দু-পাশে খাঁজ কাটা থাকত, যাতে মুগা সুতা দিয়ে ডান্ডির সঙ্গে বাঁধা হত I       

যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীকে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির সংগীত সভায় নিযুক্ত করেন ও অনুজ সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুরকে (১৮৪০-১৯১৪ খ্রি:) ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী সংগীত শিক্ষা দেন l সৌরিন্দ্রমোহন উত্তম সেতার বাদক ছিলেন l তিনি ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীকে তিন রেখার দন্ড-মাত্রিক স্বরলিপিকে এক লাইনের দন্ড-মাত্রিক স্বরলিপিতে রূপান্তর করনে সাহায্য করেন l ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় l কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় পাশ্চাত্য স্বরলিপির অনুকরণে বিন্দু-মাত্রিক স্বরলিপি সৃষ্টি করেছিলেন l

বিষ্ণুপুরের গঙ্গানারায়ন বন্দোপাধ্যায় মহাশয়ের পুত্র অনন্তলাল বন্দোপাধ্যায় প্রথম জীবনে কথকতা অনুশীলনে মনোনিবেশ করেন ও পরবর্তীকালে রামশঙ্কর ভট্টাচার্যেরশিষ্যত্ব গ্রহন করেন l অনন্তলাল বন্দোপাধ্যায়ের চার পুত্র রামপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায় , গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায় , সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় ও রামকৃষ্ণ বন্দোপাধ্যায় পিতার যোগ্য উত্তরসূরী ছিলেন বিষ্ণুপুরের সংগীত সমাজে l অনন্তলাল বন্দোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র রামপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায় (১৮৭১-১৯২৭ খ্রি:) ধ্রুপদগায়ক ও সেই সঙ্গে সুরবাহার , সেতার , ন্যাসতরঙ্গ , জলতরঙ্গ , এস্রাজ , বীণা , পাখোয়াজ , তবলা প্রভৃতি বাদনে দক্ষ শিল্পী ছিলেন l৮    তিনি এক লাইনের দন্ড-মাত্রিক স্বরলিপিকে আরো খানিকটা রূপান্তর করেন এবং তাঁর রচিত সকল গ্রন্থে সেই স্বরলিপি ব্যবহার করেন l

 

অনন্তলাল বন্দোপাধ্যায়ের দ্বিতীয় পুত্র গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায় সেতার বাদক ও ধ্রুপদগায়ক ছিলেন l তাঁর বাজানো সেতারের রেকর্ডিং থেকে বোঝা যায় যে তাঁর বাজনা ছিল RIGHT HAND BASED  অর্থাৎ সেতার বাজানোতে বাম হাতের কাজ কম ছিল l ডা রা ডিরি ডিরি ইত্যাদি বোলের প্রয়োগ বেশি করতেন , এক পর্দার গমক ও দুই পর্দার মিড়ের কাজ , দেড় ও দ্বিগুণ লয়কারী সহ তান পাওয়া যায় তাঁর বাজনায় l তিনি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর আবিস্কৃত আকার মাত্রিক স্বরলিপি পদ্ধতি অনুসরন করতেন এবং তাঁর রচিত সকল গ্রন্থে এই  স্বরলিপি ব্যবহার করেছেন l

রামপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়ের শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায় , সঙ্গীতাচার্য গোকুল নাগ প্রমূখ l সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায় প্রথমে তাঁর মেজকাকা গোপেশ্বর বন্দোপাধ্যায়ের কাছে সংগীত শিক্ষা করেছিলেন l পরবর্তীকালে রামপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়ের নিকট সেতার ও সুরবাহার শিক্ষা করেন l তিনিওতাঁর মেজকাকার মত আকার মাত্রিক স্বরলিপি পদ্ধতি অনুসরন করতেন l সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের সেতারের সাথে পুর্ববর্তী সকল সেতার বাদকদের সেতারের আকৃতিগত , পরিবেশনগত পার্থক্য লক্ষ্যনীয় l তাঁর সেতার বাদনে খড়জের তারের অতিমন্দ্রের কাজ , শুধুমাত্র ডা রা ডিরি ডিরি ইত্যাদি বোলের  অধিক প্রয়োগ না করে কন্ঠসংগীতের আঙ্গিকে গায়কী ঢঙের প্রয়োগ , তিন থেকে চার পর্দার মিড় , ধ্রুপদগানের অনুকরণে জোড়-আলাপ , উলট-সুলট ঝালা , একহারা তান , ঝালা বাদনকালে প্রথম ও চতুর্থ আঙ্গুলের প্রয়োগ ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়  - যা পূর্বউল্লেখিত বিষ্ণুপুর ঘরানার সেতার বাদকদের সেতার চর্চায় সেরকম ভাবে প্রমান পাইনা l তিনি সেতারে লৌহ ও পেতলের তারের পরিবর্তে বর্তমানে সেতারে ব্যবহৃত স্টিলের ও ব্রোঞ্জের তার ব্যবহার করতেন বলে অনুমান করা যায় – কারন লৌহের তারে তিন-চার পর্দার মিড় করা সম্ভব নয় l তবে তাঁর পুর্ববর্তী বিষ্ণুপুর ঘরানার কোন বাদক স্টিলের ও ব্রোঞ্জের তার ব্যবহার করতেন বলে এখন পর্যন্ত প্রমান পাওয়া যায়নি l সত্যকিঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের সেতারের পর্দ্দা Jerman Silver এর রড কেটে বানানো (ছবি থেকে জানা যায় ) I 

রামপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়ের অন্যতম প্রিয় শিষ্য ছিলেন সঙ্গীতাচার্য গোকুল নাগ – যিনি কন্ঠসংগীতের সাথে সাথে একাধারে বীণা , সেতার , এস্রাজ , সুরবাহার প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র চর্চা করেছেন l গোকুল নাগের সেতার বাদনে ধ্রুপদ অঙ্গের (ঢিমালয়ের আলাপ ) , জোড়-অংশে বোল-বাণীর ব্যবহার , তারপড়ণ , ঝালা বাদনকালে কড়ে আঙ্গুলের ব্যবহার , বীণা ও সুরবাহার এর মত করে সেতার বাজানোর সময় তর্জনী ও মধ্যমা আঙ্গুলের ব্যবহার প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য l সঙ্গীতাচার্য গোকুল নাগের পুত্র ও শিষ্য পন্ডিত মনিলাল নাগ ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্বের প্রথম সারির সেতার বাদকদের মধ্যে অন্যতম l তিনি ছোটবেলা থেকেই কন্ঠ সংগীতের পাশাপাশি সেতার ও সুরবাহার শিক্ষা করেন পিতার কাছে l পরবর্তীকালে বেনারস ঘরানার তবলাবাদক পন্ডিত কিষান মহারাজ-জির সান্নিধ্য লাভ করেন এবং বেনারস ঘরানার যে লয়কারী ভাবনা- তা আত্মীকরণ করেন নিজের সেতার বাদন শৈলীতে ,যা তাঁর পিতার থেকে খানিকটা আলাদা l এছাড়া সেতার বাদনে ধ্রুপদ অঙ্গের আলাপ এর সঙ্গে খানিকটা খেয়াল অঙ্গের অলঙ্কার মিশ্রন করেন শ্রোতাদের মনোরঞ্জনের জন্য l এছাড়া তিনি পিতার কড়ে আঙ্গুলের ঝালাকে গ্রহন না করে এক আঙ্গুলে (তর্জনী)ঝালা বাদন অভ্যাস করেন l পন্ডিত মনিলাল নাগের কন্যা শ্রীমতি মিতা নাগ বিষ্ণুপুর ঘরানার সেতার বাদন চর্চার বর্তমান প্রজন্মের অন্যতম ধারক ও বাহক l তাঁর সেতার বাদনে বোল ও স্বরের সমন্বয় তান-প্রকরণ , একটি বোল একটি স্বর রীতি মেনে নানা স্বরসমষ্টি গঠন , তিন সপ্তক ব্যপী মিড় , গমক সহ তান , কৃন্তন অলঙ্কারের প্রয়োগ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য l

তাহলে দেখা গেল ক্ষেত্রমোহন গোস্বামীর (১৮২৩-১৮৯৩ খ্রি:)সময়ে সেতারে ব্যবহৃত লৌহ ও পেতলের তার থেকে বিবর্তনের ধারায় এসে বর্তমানে স্টিলের ও ব্রোঞ্জের তার ব্যবহার করা হচ্ছে I পর্দ্দারও আকৃতি গত পরিবর্তন হয়েছে I আগে যেখানে সেতার বাজানোর সময় বীণার মত করে দু-আঙ্গুল ব্যবহার করা হত ,বর্তমানে শুধুমাত্র তর্জনী ব্যবহার করা হয় I এছাড়া শুধুমাত্র RIGHT HAND BASED  অর্থাৎ সেতার বাজানোতে ডা রা ডিরি ডিরি ইত্যাদি বোলের প্রয়োগ কমে বর্তমানে গানের অনুকরণে ‘গায়কী ঢংয়ের’ প্রয়োগ দেখা যাচ্ছে বিষ্ণুপুর ঘরানার বর্তমান প্রজন্মের সংগীত গুনীদের সেতার বাজনায় I রাগ-রাগিনী পরিবেশনের ক্ষেত্রেও দেখা যায় পূর্বে বিষ্ণুপুর ঘরানায় চর্চিত কিছু রাগ-রাগিনী যা উত্তর ভারতীয় প্রচলিত রাগ-রাগিনীর রূপ থেকে খানিকতা আলাদা ছিল- সেখান থেকে আস্তে আস্তে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানে সর্বভারতে প্রচলিত রাগ-রাগিনীর রূপকে গ্রহন করেছে I স্বরলিপির ক্ষেত্রেও আমরা এই ঘরানায় বিভিন্ন প্রকার স্বরলিপির ব্যবহার দেখতে পাই I

বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে ও তথ্য প্রযুক্তির উন্নতির ফলে সংগীতচিন্তার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে l এহেন পরিস্থিতিতে বিষ্ণুপুর ঘরানায় চর্চিত সেতার আয়ত্ত করার নিষ্ঠা , অধ্যবসায় ও ঘরানার যথার্থ উত্তরসাধকদের সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় সাধারন মানুষের কাছে এই ঘরানার অনেক তথ্য বিস্মৃতি ও অবলুপ্তির পথে l এই ঘরানায় চর্চিত সেতার সাধনার বিশাল পরিধি উপলব্ধি করতে হলে এই ঘরানার স্বাতন্ত্র্য বাদনশৈলী বোঝার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমার মনে হয় l         

                                                                তথ্য সূত্র ও সন্দর্ভ সূচী

 

১. মুখোপাদ্ধ্যায়, দিলীপকুমার. ভারতীয় সঙ্গীতে ঘরানার ইতিহাস. কলিকাতা : বিপুল চট্টোপাধ্যায়, ১৩৮৪ I                                                                                                                                         

২. বন্দোপাধ্যায়, গোপেশ্বর. সঙ্গীতচন্দ্রিকা. কলিকাতা : রমেন্দ্রনাথ মল্লিক, ১৩৭৪ I

৩. বন্দোপাধ্যায়, রামপ্রসন্ন. সঙ্গীতমঞ্জরী. সম্পা:- ড. প্র্দিপকুমার ঘোষ ও সুভাষ চৌধুরী. কলিকাতা : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি, ২০০৯ l

৪. -.সঙ্গীতমঞ্জরী . কলিকাতা : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি, ২০০৯ l

৫. বন্দোপাধ্যায়. সঙ্গীতচন্দ্রিকা. কলিকাতা : রমেন্দ্রনাথ মল্লিক, ১৩৭৪ I

৬. গোস্বামী, ক্ষেত্রমোহন. সঙ্গীতসার . কলিকাতা : কালীপ্রসন্ন বন্দোপাধ্যায়, ১৮৭৯ I

৭. শ্রী প্রীতম পাল (বাদ্যযন্ত্র নির্মাতা) মহাশয়ের ব্যক্তিগত সাক্ষাতকার থেকে প্রাপ্ত তথ্য I

৮. বন্দোপাধ্যায়, সত্যকিঙ্কর. বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রকৃত ইতিহাস ও রাগরূপের সঠিক পরিচয়. কলিকাতা : সত্যকিঙ্কর                     বন্দোপাধ্যায় , ১৯৬৯ l

৯. “Raag Tori- Satyakinkar Banerjee” , accessed , June10, 2013 ,  http://www.youtube.com/watch?v=2sv58bDrP6c